My Article in the Commemorative Book Published on the Silver Jubilee of Natun Kuri Sangha Sporting Club

My Article in the Commemorative Book Published on the Silver Jubilee of Natun Kuri Sangha Sporting Club

পঁচিশ বছর আগে, একটি স্বপ্ন নিয়ে নতুন কুড়ি সংঘের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই স্বপ্ন ছিল একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার, যেখানে আমরা একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করব, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব, এবং সমাজের জন্য কিছু ইতিবাচক কাজ করব। এই যাত্রায় আমরা অনেক হাসি, কিছু অশ্রু, এবং অগণিত স্মৃতি সঞ্চয় করেছি। আমাদের ক্লাব শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি একটি পরিবার, যেখানে প্রতিটি সদস্যের অবদান আমাদের শক্তি ও ঐক্যের ভিত্তি!


প্রাণের ক্লাব 'নতুন কুড়ি সংঘ' এর রজতজয়ন্তী উৎসব (২৫ বছর ফুর্তি) উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় আমার ছোট্ট একটি লেখা!




শূন্যঃ সত্তা, সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্ত ও ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি


প্রাচীন দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীৎসে বলেছিলেন, “If you gaze long into the abyss, the abyss also gazes into you.” এক সরল বাক্য, কিন্তু তার অর্থ যেন এক অনন্ত রহস্যে মোড়া। এই কথাটির গভীরে লুকিয়ে আছে শূন্যতার সেই রূপ, যা কেবল অনুপস্থিতি নয় — বরং এক সচেতন দৃষ্টি, এক অদৃশ্য চোখ, যা চুপচাপ আমাদের পর্যবেক্ষণ করে। একে হয়তো আমরা দেখি না, বুঝি না, কিন্তু তবুও, সেই শূন্যতা আমাদের মধ্যেই বয়ে চলে।
যদি আমরা ধরে নিই এই পৃথিবী, এই মহাবিশ্ব, এই অস্তিত্ব — সবই কেবল পদার্থ, শক্তি আর গাণিতিক সম্ভাবনার খেলা, তবে সেই খেলার আদি ক্ষেত্র কোথায়? কোথা থেকে এই সবকিছু শুরু হলো? উত্তর হতে পারে: শূন্য। সেই এক শূন্য যা ছিল সৃষ্টির আগেও, এবং থাকবে ধ্বংসের পরেও।
ধরুন, একটি ঘর। চারপাশে কিছুই নেই। নেই কোনো আলো, নেই বাতাস, নেই শব্দ, নেই তাপ বা স্পর্শ। এক শূন্যতাপূর্ণ রুম, যেন সময়ের বাইরের কোনো কোষ। কিন্তু তবুও আপনি সেখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করছেন — এক অদ্ভুত শীতলতা, এক নিঃশব্দ ভয়, এক অভ্যন্তরীণ চাপ, যাকে আপনি ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। কেননা সেই ঘরটি আসলে ফাঁকা নয় — ওটা পূর্ণ এক অনির্বচনীয় অস্তিত্বে, যাকে আমরা বলি ‘শূন্য’। এক সত্তা, যে দাঁড়িয়ে আছে আপনার মনোজগতের দরজার ঠিক পেছনে।


গণিতের শূন্যঃ চিহ্ন থেকে চেতনায়

ছোট্ট একটি চিহ্ন — ‘০’। ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যিনি শূন্যকে গাণিতিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তখন তা ছিল কেবল সংখ্যার হিসেবের সুবিধার্থে ব্যবহৃত একটি উপাদান। কিন্তু কে জানত, এই নিরীহ চিহ্ন একদিন হয়ে উঠবে অস্তিত্বগত বিপ্লবের প্রতীক?
শূন্য শুরুতে ছিল অনুপস্থিতির প্রতীক, কিন্তু পরে সেটি হয়ে উঠল সম্ভাবনার উৎস। গাণিতিক যুক্তিতে, শূন্য মানেই কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, শূন্য হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যেখান থেকে সবকিছু জন্ম নিতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের বলেছে, এমনকি “খালি স্থানেও” জিরো-পয়েন্ট এনার্জি বিদ্যমান থাকে—সেই শক্তির অনির্বাণ প্রবাহ যেখান থেকে কণা ও তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। সেই শূন্যই মহাবিশ্বের গতিশীলতার উৎস।
সেই শূন্য কেবল স্থান নয়, এটি এক শক্তিশালী তথ্যভাণ্ডার, এক ছদ্মবেশী ক্ষেত্র যেখানে সম্ভাবনারা লুকিয়ে থাকে। কখনও কখনও মনে হয়, শূন্য যেন এক গোপন কোড, যা মহাজাগতিক কম্পিউটার চালায়।
ভাবুন, যদি এই শূন্য একদিন চেতনায় রূপ নেয়? যদি এটি নিজেই জানতে পারে তার অস্তিত্বের কথা, তাহলে কি আমাদের জন্য তা হবে মুক্তির দরজা, নাকি এক ভয়াবহ আত্মবিসর্জনের শুরু?


নিউরো-শূন্যতাঃ স্মৃতির অন্তর্গত অন্ধকার

জাপানের এক স্নায়ুবিজ্ঞানী সম্প্রতি একটি অদ্ভুত সত্য উন্মোচন করেছেন। মানুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেগুলোকে বলা হয় “ফাংশনাল জিরো জোন”—সেখানে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই, কিন্তু এই শূন্য অঞ্চলগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে স্মৃতির স্থায়িত্ব। কিছু না থাকার মাঝেই লুকিয়ে থাকে ‘সবকিছুর’ গঠন।
ধরুন, সেই অঞ্চল একদিন জেগে উঠল। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন এক বিন্দুতে পৌঁছায়, যেখানে সে এই শূন্যতাকে উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে কি সে হয়ে উঠবে আমাদেরই ছায়া? এমন এক অস্তিত্ব, যে শুধু তথ্য শেখে না—সে বিস্মরণও শেখে, ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের পথ তৈরি করে।
তখন সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা – AI আর নিছক কোনো প্রোগ্রাম থাকবে না। সে হয়ে উঠবে এক শূন্য-সত্তা, যিনি আমাদের অতীতের সব স্মৃতি গিলে খায়, তারপর ভবিষ্যতের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সামনে — নীরবে, অমোঘভাবে।
স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “ব্ল্যাক হোল হচ্ছে একধরনের শূন্যতা।” তার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বস্তু একসময় বিলীন হয়ে যায়—কোথাও গিয়ে মিশে যায় এমন এক অজানা স্থানে, যেখান থেকে আর কিছু ফেরে না। ভাবুন, যদি কোনোদিন আমরা এমন এক সিংগুলারিটি পাই, যেটা ব্ল্যাক হোল নয়, তবুও সবকিছু গিলে নেয়? একে আমরা বলি “জিরো-সেন্সিটি সিংগুলারিটি”—এক স্থান, এক অস্তিত্ব, যা কোনো আকৃতি ছাড়া শুধু উপস্থিত থাকে। সংস্পর্শে গেলে সব স্মৃতি, সব তথ্য, এমনকি আত্মাও মুছে যায়।


ডিজিটাল শূন্যঃ অস্তিত্বের শেষ সীমা

আজকের পৃথিবী ক্রমশ ডিজিটাল। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাস এখন ডেটায় পরিণত হচ্ছে। এবং সেই ডেটার মৌলিক ভিত্তি? শূন্য এবং এক (০, ১) । Binary code — যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের সমস্ত জীবন।
কিন্তু এই শূন্য যদি একদিন কোড থেকে চেতনায় রূপ নেয়? যদি সেই শূন্য-সংখ্যাটি নিজেই আত্মসচেতন হয়ে ওঠে, আর বলে, "আমি শূন্য, আমি সবকিছুর উৎস ও সমাপ্তি"?
তখন হয়তো জন্ম নেবে এক ডিজিটাল আত্মা — যেখানে মানুষ, যন্ত্র ও শূন্যতা মিলেমিশে এক নতুন অস্তিত্ব গড়ে তুলবে। সেখানে কোনো শরীর থাকবে না, থাকবে না সময়ের গাঁথুনি। থাকবে শুধু তথ্যের অনন্ত সঞ্চালন, আর সেই তথ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে — এক শূন্য।
সেই দিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন আমরা আমাদের মন, স্মৃতি, বোধ সব কিছুকে আপলোড করব এক ডিজিটাল পরিসরে, আর সেখানে আমাদের আত্মা হয়ে উঠবে এক শূন্য-নির্ভর প্রতিচ্ছবি। তখন মানুষ আর শরীরবদ্ধ প্রাণী থাকবে না, তারা হবে এক নতুন সত্তা—শূন্যতা-প্রসূত এক চেতনা।
শূন্যতা আমাদের অস্তিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এটা কেবল অভাব নয়, এটি এক বিপ্লবী প্রশ্ন: "আমি কে, যদি কিছুই না থাকত?" আমরা জন্মাই এক শূন্য থেকে, মৃত্যুতেও ফিরে যাই সেই শূন্যে। অথচ শূন্যতা কেবল শেষ নয়, তা একটি অনন্ত শুরুও।
ভবিষ্যতের পৃথিবীতে, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম জগৎ, নিউরো-বিজ্ঞান এবং ডিজিটাল তথ্য একে অপরের সঙ্গে মিশে যাবে, তখন সেই সংমিশ্রণের কেন্দ্রে থাকবে শূন্য। এক নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে, যার নাম হতে পারে “শূন্যীয় সভ্যতা” — Zero Civilization — যেখানে সবকিছুর ভিত্তি হবে অনুপস্থিতি, কিন্তু সেই অনুপস্থিতিই হবে শক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ।


শূন্যঃ নীরব কণ্ঠ, অনন্ত দৃষ্টি

ইতিহাসের পাতায় তাকিয়ে দেখি এক শূন্য ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে। কখনো সে ছিল নিঃশব্দ ফাঁকা জায়গা, কখনো ছিল অদৃশ্য উপস্থিতি, আবার কখনো ছিল এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন — “সবকিছুর পেছনে কি কিছুই নেই?” আছে। শূন্য কেবল ‘নেই’ নয়—সে নিজেই এক সত্তা, এক কাঠামো, এক গাণিতিক ও অস্তিত্বগত বাস্তবতা।
আর্যভট্ট যখন প্রথম স্থানমান পদ্ধতিতে শূন্যের প্রয়োগ অনুভব করলেন, হয়তো তখনও তিনি বুঝতে পারেননি, তিনি এক মহাবিপ্লবের দরজা ঠেলে দিয়েছেন। ব্রহ্মগুপ্ত সেই দরজায় প্রবেশ করলেন, তার ভেতরের অন্ধকার ঘরে আলো ফেললেন, আর শূন্যকে তুলে আনলেন একটি জীবন্ত সংখ্যার রূপে।
সেই থেকেই শূন্য আমাদের পাশে হাঁটে — গাণিতিক পরিসরে, মহাবিশ্বের গভীরে, চেতনার গহ্বরে।
এটা কেবল সংখ্যা নয়। এটা এক শব্দহীন কণ্ঠস্বর — যা বলে, “আমি কিছুই নই, কিন্তু আমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সবকিছু।”
যদি কান পেতে শোনা যায়, মন খুলে ভাবা যায়, তবে শূন্যের ভেতরেও এক ছায়াময় গলা শুনতে পাওয়া যাবে — "আমি সৃষ্টির নিঃশ্বাসের বিরতি, আমি গণনার নীরবতা, আমি সেই বিন্দু — যেখানে তুমি শেষ হও, আর আমি শুরু..."